টাকা আসলে কি ?


পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদিত জিনিস (product) কে বলা হয় পণ্য (commodity)। পণ্য বা কমোডিটির বৈশিষ্ট্য হল তার মূল্য বা ভ্যালুকে দুইভাবে বিবেচনা করা হয়ঃ একটি হল তার use value বা ব্যবহারিক মূল্য আর আরেকটি হল তার exchange value বা বিনিময় মূল্য। Use value বা ব্যবহারিক মূল্য হল পণ্য স্বয়ং। আর Exchange value বা বিনিময় মূল্য হল পণ্যটির মূল্য (value), যা দামের (price) মাধ্যমে টাকায় প্রকাশিত হয়। পণ্যের এই use value এবং exchange value দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। অর্থাৎ, একপ্রান্তে থাকে পণ্যটি আর অপর প্রান্তে থাকে টাকা।

 

পণ্যের মধ্যে যুগপৎভাবে নিহিত থাকা ইউজ ভ্যালু ও একচেঞ্জ ভ্যালুকে আলাদা ভাবে বিবেচনা করার মাধ্যমে বিমূর্ত একচেঞ্জ ভ্যালুকে মূর্ত রূপদানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটে একচেঞ্জ ভ্যালু বা ভ্যালুকে টাকায় রূপদানের মাধ্যমে। অর্থাৎ বিমূর্ত একচেঞ্জ ভ্যালু টাকায় প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূর্ত রুপ লাভ করে; অদৃশ্য অবস্থা থেকে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

 

এইভাবে টাকার মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান মূর্তরূপ লাভ করার মাধ্যমে একচেঞ্জ ভ্যালু আর উদ্বায়ী থাকে না। চাইলেই এখন তাকে ধরে রাখা যায়, পরে ব্যবহারের জন্য বা বিনিয়োগের জন্য জমিয়ে রাখা যায়। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় পুঁজি বা ক্যাপিটালের। তাই পুঁজির গাঠনিক উপাদান হলো একচেঞ্জ ভ্যালু, যা পণ্যের ইউজ ভ্যালু থেকে পৃথক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং টাকায় প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে মূর্ত রুপ লাভ করে। এজন্যই মার্কস পুঁজি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন পণ্যকে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে।

 

পণ্যের use value বা ব্যবহারিক মূল্য থেকে exchange value বা বিনিময় মূল্য কে আলাদাভাবে বিবেচনা করার এই নিয়ম একেবারেই পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার নিজস্ব চরিত্র। প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ--পাশ্চাত্য যাকে 'অসভ্য' বা 'বর্বর সমাজ' হিসেবে বিবেচনা করে-- সেই সকল সমাজে পণ্যের শরীর (use value) থেকে মূল্য (exchange value) কে আলাদাভাবে গণ্য করার কোন রীতি ছিল না। এ প্রসঙ্গে মার্কস বলছেন,

‘To the simple owner of commodities among the barbarians, and even to the peasant of Western Europe, value is inseparable from the value-form…’

 

কিন্তু, পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় মূল্য দুটি ভিন্নরূপে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে use value আর exchange value বা value রূপে। আর তাই একটি পণ্য বিচলনক্ষেত্রে দ্বি-বিভাজিত হয়ে পণ্য আর টাকা রূপে হাজির হয় দুইজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে, যাদের একজন ক্রেতা আর আরেকজন বিক্রেতা। এ কথাগুলোই মার্কস বলছেন এভাবে,

‘In the direct form of commodity circulation hitherto considered, we found a given value always presented to us in a double shape, as a commodity at one pole, and money at the opposite pole.’

 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় use value আকারে বা শুধুই তার ব্যবহারিক রূপ নিয়ে পণ্য হাজির হলেও পণ্যের সত্তা মূলত তার বিনিময় মূল্যের মধ্যে নিহিত। পণ্যের প্রাকৃতিক গুণ বা ব্যবহার উপযোগিতা থাকলেও পণ্যের মূল্য (value)-- যাকে মার্কস exchange value বা বিনিময় মূল্য বলেছেন – হাজির হয় পণ্য থেকে বিযুক্ত হয়ে। অতএব ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময় মূল্যের এই বিভাজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই দিকটা না বুঝলে এই পণ্যের exchange value বা value, যা কিনা পণ্যের অন্তর্নিহিত গুণ হিসেবে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি, সেটা যে পণ্যের প্রাকৃতিক কোন গুণ নয়, বরং বাজারে বিনিময়ের মধ্য দিয়ে উদিত হয়, এটা সহজে ধরা পড়ে না। বিনিময়ের অনিবার্য ফল হল টাকার আবির্ভাব। Exchange value বা বিনিময় মূল্যের পণ্য বা use value থেকে বিযুক্ত হয়ে আলাদাভাবে বিবেচিত হওয়াটাই টাকার আবির্ভাবের পূর্বশর্ত। তাই পণ্যের ব্যবহারিক গুণ বা use value থেকে বিযুক্ত হয়ে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিনিময় মূল্য বা exchange value হিসেবে আলাদাভাবে বিবেচিত হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। মার্কসের মূদ্রাতত্ত্ব বুঝতে হলে এই গোড়ার আলোচনা পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

 

পণ্য নিজে, অর্থাৎ ব্যবহারিক মূল্য বা use value, আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়েই অনুভব করতে পারি। অর্থাৎ, এটা concrete একটা বিষয়। কিন্তু exchange value বা বিনিময় মূল্য, যাকে পরবর্তীতে মার্কস সাধারণভাবে value বা মূল্য বলেছেন, তা কিন্তু ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ কোন বিষয় নয়। অর্থাৎ, এটি একটি abstract বিষয়। কিন্তু যখন পণ্যের use value থেকে exchange value কে আলাদা করা হয়, অর্থাৎ একদিকে থাকে পণ্য আর অপরদিকে থাকে পণ্যটির মূল্য, তখন আসলে কি ঘটে? তখন একদিকে মূর্তরূপে হাজির থাকে পণ্যটি আর অপরদিকে বিমূর্তরূপে হাজির থাকে মূল্য (value) বা বিনিময় মূল্য (exchange value)। কিন্তু বাজারে যখন কেনা-বেচার মাধ্যমে বিনিময় ঘটে, তখন মূর্ত কিছুর সঙ্গে মূর্ত কিছুরই বিনিময় করা সম্ভব; মূর্ত (concrete) কিছুর সাথে বিমূর্ত (abstract) কিছুর বিনিময় সম্ভব নয়। ফলে এসময় প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিমূর্ত বা abstract রূপে বিরাজ করা বিনিময় মূল্য (exchange value) বা মূল্য (value) কে concrete বা মূর্ত রূপ প্রদানের।

 

কিভাবে বিমূর্ত রূপে বিরাজ করা মূল্য কে মূর্ত রূপ দান করা হয়?

 

করা হয় টাকার মাধ্যমে। উল্লেখ্য, টাকা মানে শুধুই কাগুজে টাকা বা নোট নয়। টাকার একটা বিবর্তনের ইতিহাস আছে, যা মার্কস তার ক্যাপিটাল ভলিউম এক এর প্রথম দিকেই আলোচনা করেছেন। সেই ইতিহাসের আদিপর্বে টাকা ছিল মূল্যবান ধাতব মুদ্রা রূপে, যেমনঃ সোনা, রুপা, ইত্যাদি পদার্থের মুদ্রা। প্রাথমিক পর্যায়ে মূল্য পরিমাপ করা হতো এসব মূল্যবান ধাতুর ওজনের এককেই। অর্থাৎ, ওজনের একক যেমন ছিল আউন্স, পাউন্ড ইত্যাদি, তেমন অর্থের অঙ্কে পরিমাপ করার জন্য মূল্যের একক হিসেবেও আউন্স, পাউন্ডই ব্যবহৃত হতো। এর ফলে এক আউন্স ওজনের স্বর্ণের সমপরিমাণ মূল্য প্রকাশ করতে এক আউন্স পরিমাণ স্বর্ণ আছে, এমন ধাতব স্বর্ণমুদ্রাই ব্যবহৃত হতো।

 

কিন্তু এর নানাবিধ বাস্তব সমস্যা ছিল। যেমনঃ বড় লেনদেনে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা লাগতো, ওজনে ভারী হওয়ায় ধাতব স্বর্ণমুদ্রা বহন করা সমস্যাজনক ছিল, হাতবদলের ফলে এসব ধাতব মুদ্রার ক্ষয় ঘটতো—ফলে মাপলে দেখা যেতো এক আউন্স স্বর্ণ মুদ্রায় আসলে এক আউন্স পরিমাণে স্বর্ণ নেই। ফলে এক পর্যায়ে গিয়ে এক আউন্স বা এক পাউন্ডের স্বর্ণমূদ্রার value হয়ে ওঠে nominal value. অর্থাৎ, এক আউন্সের স্বর্ণমুদ্রায় এক আউন্স পরিমাণ স্বর্ণই থাকতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা আর থাকে না। মানে, এক আউন্স ওজনের স্বর্ণের সমপরিমাণ মূল্য প্রকাশ করতে এমন ধাতব স্বর্ণমুদ্রা ক্রমশ প্রচলিত হতে শুরু হয়, যা নামে এক আউন্সের মুদ্রা হিসেবে পরিচিত হলেও তাতে এক আউন্স পরিমাণ স্বর্ণ থাকতো না। ফলে মূল্যবান ধাতুর ওজনের একক হিসেবে আউন্স, পাউন্ড আর মূল্যের একক হিসেবে আউন্স, পাউন্ডের সমার্থক রইল না। মূল্যবান ধাতব মুদ্রার value হয়ে উঠলো nominal value বা প্রতীকী মূল্য।

 

তো, nominal value-ই যদি value কে প্রকাশ করতে পারে তাহলে বিমূর্ত রূপে বিরাজ করা মূল্য বা value কে মূর্ত রূপ প্রদানের জন্য সোনা বা রুপার মতো মূল্যবান ধাতব মুদ্রার কি দরকার? এক টুকরো কাগজও তো সেটা করতে পারে! আর তাই কালক্রমে মূল্যবান ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে টাকা হিসেবে প্রচলন ঘটে কাগুজে নোটের।

 

এ প্রসঙ্গে মার্কসের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্যঃ

‘The fact that the circulation of money itself splits the nominal content of coins away from their real content, dividing their metallic existence from their functional existence, this fact implies the latent possibility of replacing metallic money with tokens made of some other material, i.e. symbols which would perform the function of coins.’

 

কাগজের নোট সম্পর্কে মার্কসের বক্তব্য কি? দেখা যাক মার্কস কি বলছেন এ ব্যাপারেঃ

‘The metallic content of silver and copper tokens is arbitrarily determined by law. In the course of circulation they wear down even more rapidly than gold coins. Their function as coins is therefore in practice entirely independent of their weight, i.e. it is independent of all value. In its form of existence as coin, gold becomes completely divorced from the substance of its value. Relatively valueless objects, therefore, such as paper notes, can serve as coins in place of gold. This purely symbolic character of the currency is still somewhat disguised in the case of metal tokens. In paper money it stands out plainly. But we can see: everything depends on the first step.’

 

মার্কস আরো বলছেন,

‘...inconvertible paper money (is) issued by the state and given forced currency. This money emerges directly out of the circulation of metallic money.’

 

সবশেষে মার্কস পরিষ্কারভাবে বলছেন, টাকা মূল্যবান ধাতব মুদ্রা থেকে কাগুজে নোট—যে কোন কিছুই হতে পারেঃ

‘The commodity which functions as a measure of value and therefore also as the medium of circulation, either in its own body or through a representative, is money. Gold (or silver) is therefore money.

On the other hand, it also functions as money when its function, whether performed in person or by a representative, causes it to be fixed as the sole form of value, or, in other words, as the only adequate form of existence of exchange value in the face of all the other commodities, here playing the role of use-values pure and simple.’

 

এ পর্যন্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে দেখলাম, কালক্রমে বিভিন্ন কারণে মূল্যবান ধাতব মুদ্রা যখন আর এসব মূল্যবান ধাতুর ‘real value’ কে ধারণ না করে ‘nominal value’ এর বাহক হয়ে উঠলো, অর্থাৎ প্রতীকী মূল্যের বাহক হয়ে উঠলো, তখন একপর্যায়ে টাকা হিসেবে কাগজের নোটের প্রচলন শুরু হল। প্রতীকী মূল্য বা nominal value এর বাহক হিসেবে কাগজের নোট প্রস্তুত এবং তা বাজারে ছাড়ার অধিকার এককভাবে শুধু রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত মুদ্রা শুধু সেই রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যেই কার্যকর, যে সীমানা একইসাথে পণ্য চলাচলের সীমানাও বটে। রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে পণ্য যখন আন্তর্জাতিক পরিসরে লেনদেন হয়, তখন স্ব স্ব রাষ্ট্রের মুদ্রা অচল হয়ে পড়ে। তখন প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রার। এ প্রসঙ্গে মার্কসের বক্তব্যঃ

‘The different national uniforms worn at home by gold and silver as coins, but taken off again when they appear on the world market, demonstrate the separation between the internal or national spheres of commodity circulation and its universal sphere, the world market.’

 

অনেকের হয়তো আগ্রহ জাগতে পারে যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সম্পর্কে মার্কস কী বলেছেন। চলুন দেখা যাক, কী বলছেন মার্কস আন্তর্জাতিক মুদ্রা সম্পর্কেঃ

‘When money leaves the domestic sphere of circulation it loses the local functions it has acquired there, as the standard of prices, coin, and small change, and as a symbol of value, and falls back into its original form as precious metal in the shape of bullion. In world trade, commodities develop their value universally. Their independent value-form thus confronts them here too as world money. It is in the world market that money first functions to its full extent as the commodity whose natural form is also the directly social form of realization of human labour in the abstract. Its mode of existence becomes adequate to its concept.’

‘Gold and silver serve essentially as international means of purchase when the customary equilibrium in the interchange of products between different nations is suddenly disturbed. And, lastly, world money serves as the universally recognized social materialization of wealth, whenever it is not a matter of buying or paying, but of transferring wealth from one country to another, and whenever its transfer in the form of commodities is ruled out, either by the conjuncture of the market, or by the purpose of the transfer itself.’

‘Just as every country needs a reserve fund for its internal circulation, so too it requires one for circulation in the world market. The functions of hoards, therefore, arise in part out of the function of money as medium of payment and circulation internally, and in part out of its function as a world currency.

In this latter role it is always the genuine money-commodity, gold and silver in their physical shape, which is required. For that reason Sir James Steuart expressly characterizes gold and silver as ‘money of the world’ in order to distinguish them from their merely local representatives.’

 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা বা World money সম্পর্কে মার্কসের উপরোক্ত তিনটি উদ্ধৃতিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলতে তিনি শুধু স্বর্ণ বা রৌপ্য এর মতো মূল্যবান ধাতুকেই বুঝিয়েছেন। এর কারণ হল তার সময়ে টাকার মান নির্ধারিত হতো স্বর্ণমান ব্যবস্থা বা gold standard এর ভিত্তিতে।

 

যাই হোক, আমরা আমাদের মূল আলোচনা অর্থাৎ টাকা হিসেবে কাগুজে নোটের প্রসঙ্গে ফেরত আসি। তাহলে কাগুজে নোট ছাপানোর একচ্ছত্র অধিকার যখন রাষ্ট্রের হাতে, তখন রাষ্ট্র নিশ্চয়ই নিজ খেয়াল-খুশিতে যত ইচ্ছে তত কাগুজে টাকার নোট ছাপাতে পারে? না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বর্ণমান ব্যবস্থায় বা gold standard অনুযায়ী কাগুজে টাকা স্বর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী। অর্থাৎ, আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ কাগজ হলেও কাগুজে নোট মূলত প্রতীকী অর্থে স্বর্ণমুদ্রারই ভিন্ন রূপ মাত্র। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কাগুজে টাকা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণমূল্যকেই নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে মার্কসের বক্তব্যঃ

‘Paper money is a symbol of gold, a symbol of money. Its relation to the values of commodities consists only in this: they find imaginary expression in certain quantities of gold, and the same quantities are symbolically and physically represented by the paper. Only in so far as paper money represents gold, which like all other commodities has value, is it a symbol of value.’

 

এর অর্থ হল, বিচলনক্ষেত্রে বা বাজারে যত মূল্যমানের স্বর্ণমুদ্রা থাকার কথা, স্বর্ণমুদ্রার প্রতিনিধি হিসেবে ঠিক সেই সমমূল্যের কাগুজে নোট-ই থাকতে হবে। ধরা যাক, যে মূল্যমানের স্বর্ণমুদ্রার সমপরিমাণ কাগুজে টাকার নোট বিচলনক্ষেত্রে থাকার কথা, যদি তার দ্বিগুণ পরিমাণ কাগুজে নোট বাজারে ছাড়া হয়, তাহলে কি হবে? উত্তর হলঃ তাহলে আগে কাগুজে ১ টাকা দ্বারা যে পরিমাণ মূল্যকে নির্দেশ করা হত, তা প্রকাশ করতে এখন কাগুজে ২ টাকা লাগবে। অর্থাৎ, কাগুজে টাকার মান কমে যাবে। এ কথাগুলোই মার্কস বলেছেন এখানেঃ

Pieces of paper on which money-names are printed, such as £1, £5, etc., are thrown into the circulation process from outside by the state. In so far as they actually circulate in place of the same amount of gold, their movement is simply a reflection of the laws of monetary circulation itself. A law peculiar to the circulation of paper money can only spring up from the proportion in which that paper money represents gold. the issue of paper money must be restricted to the quantity of gold (or silver) which would actually be in circulation, and which is represented symbolically by the paper money. Now it is true that the quantity of gold which can be absorbed by the sphere of circulation constantly fluctuates above and below a certain average level. But despite this, the mass of the circulating medium in a given country never sinks below a certain minimum, which can be ascertained by experience. The fact that this minimum mass continually undergoes changes in its constituent parts, or that the pieces of gold of which it consists are constantly being replaced by other pieces, naturally causes no change either in its amount or in the continuity with which it flows around the sphere of circulation. It can therefore be replaced by paper symbols.

If however all the channels of circulation were today filled with paper money to the full extent of their capacity for absorbing money, they might the next day be over-full owing to the fluctuations in the circulation of commodities. There would no longer be any standard. If the paper money exceeds its proper limit, i.e. the amount in gold coins of the same denomination which could have been in circulation, then, quite apart from the danger of becoming universally discredited, it will still represent within the world of commodities only that quantity of gold which is fixed by its immanent laws. No greater quantity is capable of being represented. If the quantity of paper money represents twice the amount of gold available, then in practice £1 will be the money-name not of 1/4 of an ounce of gold, but 5/6 of an ounce. The effect is the same as if an alteration had taken place in the function of gold as the standard of prices. The values previously expressed by the price of £1 would now be expressed by the price of £2.’


মার্কস আবারো ব্যাখ্যা করছেন কেন কাগুজে নোট স্বর্ণমুদ্রা কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেঃ

‘Finally, one may ask why gold is capable of being replaced by valueless symbols of itself. As we have already seen, it is capable of being replaced in this way only if its function as coin or circulating medium can be singled out or rendered independent.

Since it is a transiently objectified reflection of the prices of commodities, it serves only as a symbol of itself, and can therefore be replaced by another symbol. One thing is necessary, however: the symbol of money must have its own objective social validity. The paper acquires this by its forced currency. The state’s compulsion can only be of any effect within that internal sphere of circulation which is circumscribed by the boundaries of a given community, but it is also only within that sphere that money is completely absorbed in its function as medium of circulation, and is therefore able to receive, in the form of paper money, a purely functional mode of existence in which it is externally separated from its metallic substance.’

 

এ পর্যায়ে কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, “ঠিক আছে, বুঝলাম যে মূল্যমানের স্বর্ণমুদ্রা বিচলনক্ষেত্রে থাকা উচিত, তার সমমূল্যমানের কাগুজে নোট স্বর্ণমুদ্রার প্রতিনিধি হিসেবে বিচলনক্ষেত্রে থাকতে পারে। কিন্তু কত মূল্যমানের স্বর্ণমুদ্রা বিচলনক্ষেত্রে থাকা উচিত, সেটা কিভাবে নির্ধারিত হয়?”

 

এর উত্তর হলঃ কি পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা বিচলনক্ষেত্রে থাকা উচিত তা নির্ধারিত হয় বিচলনক্ষেত্রে উপস্থিত পণ্যসমূহের সম্মিলিত দাম (price), টাকা বিচলনের গড় গতি অর্থাৎ কত দ্রুত টাকা-পণ্য-টাকা বা m-c-m সার্কিটের আবর্তন ঘটে, এবং টাকার (অর্থাৎ স্বর্ণের) মূল্য কত—এসবের ভিত্তিতে। মার্কস এ কথাগুলিই বলছেন এভাবেঃ

‘The law that the quantity of the circulating medium is determined by the sum of the prices of the commodities in circulation, and the average velocity of the circulation of money, may also be stated as follows: given the sum of the values of commodities, and the average rapidity of their metamorphoses, the quantity of money or of the material of money in circulation depends on its own value.’

 

আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম টাকা কে বুঝবার চেষ্টা থেকে; টাকা হিসেবে মূল্যবান ধাতু (স্বর্ণ, রৌপ্য, ইত্যাদি) এবং কাগুজে নোটের পার্থক্য বোঝার চেষ্টা থেকে। সে আলোচনা আমরা উপরে এতক্ষণ করেছি। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিতঃ টাকা আসলে কী? কিভাবে পণ্য থেকে বিযুক্ত বিমূর্ত মূল্যকে ধারণ করার মাধ্যমে কোন বস্তু টাকা হয়ে ওঠে?-- সেটা জানা। তাই এখন আমরা সেদিকেই মনোনিবেশ করবো।

 

উপরে আলোচনায় আমরা দেখেছি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য (use value) থেকে বিনিময় মূল্য (exchange value) বা মূল্য (value) কে পৃথকভাবে বিবেচনা করা হয়। ব্যবহারিক মূল্য (use value) বা পণ্য স্বয়ং মূর্ত রূপে বিরাজ করলেও বিমূর্ত (abstract) মূল্য (value) মূর্ত (concrete) রূপ ধারণ করে টাকার মধ্য দিয়ে।

 

শুনতে অবাক লাগলেও সত্য হল, মার্কসের দৃষ্টিতে টাকা নিজেও একটি পণ্য। তবে অন্য আর দশটি পণ্য থেকে সে সম্পূর্ণভাবে আলাদা।

 

কিভাবে?

 

আমরা দেখেছি যে পণ্যের মধ্যে যুগপৎ ভাবে উপস্থিত থাকে দুটি সত্তাঃ ইউজ ভ্যালু এবং এক্সচেঞ্জ ভ্যালু। আমরা যখন কোন পণ্যের কথা বলি, তখন মূলত ইউজ ভ্যালুকেই বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু ভুলে যাই যে ঐ পণ্যের মধ্যে নিহিত থাকা একচেঞ্জ ভ্যালুকে তার সহোদর ইউজ ভ্যালু থেকে পৃথক করা হয়েছে, যে একচেঞ্জ ভ্যালুও ঐ পণ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই পণ্য বলতে মার্কস শুধু ইউজ ভ্যালুকে বুঝতে নারাজ। তিনি পণ্য বলতে ইউজ ভ্যালু এবং একচেঞ্জ ভ্যালু উভয়কেই বুঝে থাকেন। ঘুরিয়ে বললে, মার্কসের কাছে ইউজ ভ্যালুও যেমন পণ্য, তেমনি একচেঞ্জ ভ্যালুও পণ্য। যেহেতু একচেঞ্জ ভ্যালুকে শুধুমাত্র টাকার মাধ্যমেই প্রকাশ করা সম্ভব, সেহেতু আমাদের শুনে চক্ষু চড়কগাছ হলেও মার্কস খুব নির্বিকার ভঙ্গিতেই বলেন যে টাকাও একটি পণ্য। তার মানে, একটি পণ্যই বিচলনক্ষেত্রে দ্বি-বিভাজিত হয়ে পণ্য আর টাকা রূপে হাজির হয়।

 

অন্য সকল পণ্য শুধুমাত্র use value কেই ধারণ করে। তাহলে এই সকল পণ্যের exchange value বা value ধারণ করবে কে? উত্তরঃ টাকা। টাকা হল সেই পণ্য যা বাদবাকী সকল পণ্যের value কে ধারণ করে। তাহলে ব্যাপারটা যেটা দাঁড়ালো তা হল, অন্য সকল পণ্য শুধুমাত্র তাদের ব্যবহারিক মূল্য (use value) কেই ধারণ করে, কিন্তু টাকা সকল পণ্যের বিনিময় মূল্য (exchange value) বা মূল্য (value) কে ধারণ করে। মানে, অন্যান্য সকল পণ্য তাদের মূল্য প্রকাশ করে টাকার মধ্য দিয়ে। কথাটাকে একটু নাটকীয়ভাবে বলা যায়, অন্যান্য সকল পণ্য তাদের মূল্য প্রকাশ করে একটি বিশেষ পণ্যের মধ্য দিয়ে যার নাম টাকা। টাকার এই বিস্ময়কর ক্ষমতার জন্য মার্কস একে বলেছেন সার্বজনীন পণ্য বা universal commodity.

 

তাই মার্কসের দৃষ্টিতে টাকাও একটি পণ্য। এ প্রসঙ্গে মার্কস বলছেন,

‘Money is the absolutely alienable commodity, because it is all other commodities divested of their shape, the product of their universal alienation. It reads all prices backwards, and thus as it were mirrors itself in the bodies of all other commodities, which provide the material through which it can come into being as a commodity. At the same time the prices, those wooing glances cast at money by commodities, define the limit of its convertibility, namely its own quantity.’

 

কথাগুলোকে ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায়, তা হল- টাকা হল অন্যান্য সকল পণ্যের একটি অভিন্ন রূপ যা ঐ সকল পণ্যসামগ্রী তাদের বিমূর্ত মূল্যকে (value) টাকার মধ্যে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে টাকাকে একটি বিশেষ পণ্যে পরিণত করে। অন্যদিকে, টাকা যেহেতু অন্যান্য সকল পণ্যের অভিন্ন রূপ, তাই এটির বিনিময়ে যেকোন পণ্যকেই পাওয়া যায়। যেকোন পণ্যের দাম (price) টাকার পরিমাণ কে নির্দেশ করে মাত্র।

 

এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, টাকা যদি একটি পণ্যই হয়ে থাকে তাহলে পণ্যের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার ব্যবহারিক মূল্য (use value) এবং বিনিময় মূল্য (exchange value) বা মূল্য (value) – এই দুটি গুণই থাকার কথা। আমরা জানলাম যে অন্যান্য সকল পণ্যের বিনিময় মূল্য বা মূল্য টাকা ধারণ করে। কিন্তু টাকার ব্যবহারিক মূল্য (use value) কে ধারণ করে? বা, টাকার ব্যবহারিক মূল্য (use value) টাই বা কী? সেটার আদৌ কি কোন অস্তিত্ব আছে?

 

যে কোন পণ্য, ধরুন একটা পোশাক, সেটা আপনি পরতে পারবেন; একটা টিভি, আপনি দেখতে পারবেন; অর্থাৎ এদের সকলের use value বা ব্যবহারিক মূল্য আছে। কিন্তু টাকা—হোক তা কাগজের বা ধাতব পদার্থের—তার use value বা ব্যবহারিক মূল্য টা কি? এটা খায় নাকি মাথায় দেয়?

 

এভাবে চিন্তা করলে টাকার কোন ব্যবহারিক মূল্য বা use value নেই। কিন্তু আমরা যদি মনে রাখি যে টাকা পণ্য হলেও তা একটি বিশেষ ধরণের পণ্য, তাহলে খেয়াল করবো যে টাকা দিয়ে যেহেতু সব পণ্যই কেনা যায়—হোক পোশাক কিংবা টিভি—তাই এটাই হল টাকার ব্যবহারিক মূল্য বা use value. অর্থাৎ, টাকার বিনিময়ে অন্যান্য সকল পণ্য কেনা যায়—এই গুণটাই টাকার ব্যবহারিক মূল্য বা use value.

 

মার্কস বলছেন,

‘But this unity of differences is expressed at two opposite poles, and at each pole in an opposite way. This is the alternating relation between the two poles: the commodity is in reality a use-value; its existence as a value appears only ideally, in its price, through which it is related to the real embodiment of its value, the gold which confronts it as its opposite. Inversely, the material of gold ranks only as the materialization of value, as money. It is therefore in reality exchange-value. Its use-value appears only ideally in the series of expressions of relative value within which it confronts all the other commodities as the totality of real embodiments of its utility. These antagonistic forms of the commodities are the real forms of motion of the process of exchange.’

 

মার্কস আরো বলছেন,

‘…as soon as the commodity has been changed into money, the money becomes its vanishing equivalent-form, whose use-value or content exists here on the spot, in the bodies of other commodities.’

 

অর্থাৎ, যেই মাত্র কোন পণ্য টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয়, সেই মাত্র সেই পণ্যটি টাকায় পরিণত হয়। তারপর সেই টাকা দিয়ে যে পণ্য ক্রয় করা হয়, সে পণ্যটিই হয়ে ওঠে টাকার ব্যবহারিক মূল্য (use value).

 

একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার হবে। মার্কস যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটাই দিচ্ছিঃ

'...But what is the commodity exchanged for? For the universal shape assumed by its own value. And what is the gold exchanged for? For a particular form of its own use-value. Why does gold confront the linen as money? Because the linen’s price of £2, its money-name, already brings it into relation with the gold as money. The commodity is divested of its original form through its sale, i.e. the moment its use-value actually attracts the gold, which previously had a merely imaginary existence in its price. The realization of a commodity’s price, or of its merely ideal value-form, is therefore at the same time, and inversely, the realization of the merely ideal use-value of money; the conversion of a commodity into money is the conversion of money into a commodity.'


এখানে মার্কস বলছেন, স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে যখন কাপড় ক্রয় করা হয়, তখন আসলে কি ঘটে? তখন কাপড় বিনিময় করা হয় কাপড়ের মূল্য (value) সার্বজনীন রূপ ধারণ করা স্বর্ণমুদ্রার সাথে। আর মূল্যের (value) সার্বজনীন রূপ স্বর্ণমুদ্রা বিনিময় করা হয় তার অসংখ্য ‘কল্পিত’ ব্যবহারিক মূল্যের (ideal use value) একটি বিশেষ রূপ কাপড়ের বিপরীতে।

 

ধরা যাক, এক গজ কাপড়ের দাম (price) ২ পাউন্ড স্বর্ণমুদ্রা। [এতক্ষণ পর্যন্ত মূল্য (value)/বিনিময় মূল্য (exchange value) বলে এসেছি। এখন দাম (price) কেন বলছি –এটা অনেকেই ভাবতে পারেন। ‘দাম’ (price) এবং 'মূল্য' (value) -এর পার্থক্য নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখেছি এর আগে, তাই এখন আর বেশি গভীরে যাচ্ছি না। এই আলোচনায় শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মূল্য (value) কে যখন টাকার অঙ্কে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে দাম (price) বলে। অর্থাৎ, ১ গজ কাপড়ের মূল্যকে যখন টাকার অঙ্কে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে দাম বলে। এখানে ২ পাউন্ড স্বর্ণমুদ্রা হল দাম (price).] তো, ২ পাউন্ড স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে যখন ১ গজ কাপড় বিক্রি করা হয়, তখন কাপড়ের মূল্য (value)--যা বিক্রির আগ মুহুর্ত পর্যন্ত বিমূর্ত অবস্থায় থাকে—তা ২ পাউন্ডের স্বর্ণমুদ্রা দামের মধ্য দিয়ে মূর্ত রূপ লাভ করে। অন্যদিকে, ক্রয়ের মাধ্যমে কাপড়ের বিমূর্ত মূল্য (value) কে স্বর্ণমুদ্রার মধ্য দিয়ে মূর্তরূপ দেবার সাথে সাথে স্বর্ণমুদ্রাও তার অসংখ্য ‘কল্পিত’ ব্যবহারিক মূল্য (ideal use value) রুপের একটিকে (এখানে কাপড়) বাস্তবে রূপ দেয়।

 

মার্কস এ ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বলছেন,

‘the money is only the representation in real life of the quantity of gold previously expressed in the imagination by the sum of the prices of the commodities.’


অর্থাৎ, পণ্যের দাম (price) আকারে যে পরিমাণ স্বর্ণ বিমূর্ত অবস্থায় কল্পনায় বিরাজ করে, তাকেই বাস্তব জগতে মূর্ত রূপ দান করে টাকা।

 

টাকা হিসেবে স্বর্ণমুদ্রা কে এখানে ব্যাখ্যা করছেন মার্কস,

‘Gold, as we saw, became ideal money, or a measure of value, because all commodities measured their values in it, and thus made it the imaginary opposite of their natural shape as objects of utility, hence the shape of their value. It became real money because the commodities, through their complete alienation, suffered a divestiture or transformation of their real shapes as objects of utility, thus making it the real embodiment of their values. When they thus assume the shape of values, commodities strip off every trace of their natural and original use-value, and of the particular kind of useful labour to which they owe their creation, in order to pupate into the homogeneous social materialization of undifferentiated human labour.’

 

বলা বাহুল্য, স্বর্ণমুদ্রা বলতে মার্কস এখানে টাকা কে নির্দেশ করছেন; স্বর্ণ ধাতুকে নয়। একইভাবে স্বর্ণের পরিমাণ বলতে টাকার পরিমাণ কে নির্দেশ করছেন তিনি।

 

মার্কস বলছেন,

‘money appears in the first phase as a solid crystal of value into which the commodity has been transformed, but afterwards it dissolves into the mere equivalent-form of the commodity.’

 

অর্থাৎ, টাকা প্রাথমিকভাবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয় বিমূর্ত মূল্যের (value) এর একটি মূর্ত রূপ আকারে। কিন্তু পরবর্তীতে টাকা পণ্যের সমমানের একটা বস্তু হিসেবেই পরিগণিত হয়।

 

এ কথাটি কেন বলছেন মার্কস? বলছেন কারণ, খেয়াল করে দেখুন, আমরা শুরুতে বলেছিলাম পণ্যের দুইটি দিকের কথাঃ ব্যবহারিক মূল্য (use value) আর বিনিময় মূল্য (exchange value) বা মূল্য (value)- এর কথা। পণ্যটি স্বয়ং নিজে হল ব্যবহারিক মূল্য (use value)। আর টাকা হল যার মধ্যে দিয়ে ঐ পণ্যের বিনিময় মূল্য (exchange value) বা মূল্য (value) নিজেকে মূর্ত রূপ দান করে। কিন্তু, বিনিময়ক্ষেত্রে বা বাজারে পণ্য আর টাকা পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে হাজির হয়। টাকার বিনিময়ে পণ্যটি যখন বিনিময় করা হয়, তখন মূলত পণ্যটি টাকার রূপ পরিগ্রহণ করে। অর্থাৎ, টাকা পণ্যের সমমানের একটা বস্তু হিসেবে পণ্যটিকে প্রতিস্থাপিত করে।

 

গুণগত পার্থক্য নির্বিশেষে সকল পণ্যের মূল্যকে সংখ্যাগতভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে টাকা। ঘুরিয়ে বললে, টাকার বিনিময়ে সকল পণ্যকেই পাওয়া যায় যেহেতু সকল পণ্যের মূল্যকেই নিজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে পারে টাকা। তাই মার্কস বলছেন,

‘Just as in money every qualitative difference between commodities is extinguished, so too for its part, as a radical leveller, it extinguishes all distinctions.’

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন টাকা সবকিছু কে কিনতে পারে? পারে কারণ টাকা সকল পণ্যের মূল্য (value) কে প্রকাশ করে। ভিন্ন ভিন্ন পণ্য তৈরিতে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের শ্রম ব্যবহৃত হলেও মূল্যে প্রকাশের সময় পণ্য ভেদে শ্রমের এই ভিন্নতা ঘুঁচে যায়, সকল শ্রমই তখন বিবেচিত হয় অভিন্ন মানব শ্রম (homogeneous human labour) হিসেবে। ফলে, পোশাক তৈরিকারী শ্রমিকের শ্রম আর টিভি প্রস্তুতকারী শ্রমিকের শ্রমের ধরণের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও তারা উভয়েই এক জায়গায় একঃ তারা উভয়েই মানব শ্রম। আর এই অভিন্নতার কারণেই তাদের মূল্য একটি অভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব। এই অভিন্ন মাধ্যমটিই হল টাকা।

 

উপরে আমরা দেখলাম যে টাকা দিয়ে সকল পণ্যই কেনা যায়। অর্থাৎ, সকল পণ্যের use value কে কিনতে পারে টাকা। কিন্তু টাকার নিজের কোন use value নেই। যেহেতু টাকার নিজস্ব কোন ব্যবহারিক মূল্য (use value) নেই, তাই টাকার নিজের কোন মূল্য বা value নেই*। সে অন্য পণ্যের মূল্য নিজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে কেবল।

 

(*টাকার নিজের যে কোন মূল্য নেই—এটা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। তাই এখানে সে আলোচনা করবো না। করবো আলাদাভাবে যেখানে Sweezy এবং Bortkiewicz এর এ সংক্রান্ত ভুল এবং সে ভুল সংশোধনে Fred Mosley এর আলোচনা এবং Mosley এর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার সামাণ্য কিছু অকিঞ্চিৎকর পর্যবেক্ষণ থাকবে।)


উপরে আলোচনায় একবার বলেছি, সকল পণ্যের মূল্য (value) প্রকাশ করে এমন যেকোন বস্তুই টাকা হতে পারে। ইতিহাসের বিবর্তনে তা কালক্রমে স্বর্ণ, রুপা, হয়ে কাগুজে নোটে পরিণত হয়েছে। তাই টাকা বলতে শুধুই স্বর্ণ, বা শুধুই কাগুজে নোট—এরকম বদ্ধমূল ধারণা যদি আমরা পোষণ করি তাহলে আমরা টাকার সত্যিকার অর্থ ধরতে পারবো না এবং তার পরিবর্তে সোনা বা অন্যকোন ধাতু কিংবা কাগুজে নোট বিশেষ গুণ সম্পন্ন--এরকম ভুল ধারণা পোষণ করবো। মার্কস তাই আমাদের সতর্ক করছেনঃ

‘If we keep in mind only this material aspect, that is, the exchange of the commodity for gold, we overlook the very thing we ought to observe, namely what has happened to the form of the commodity. We do not see that gold, as a mere commodity, is not money, and that the other commodities, through their prices, themselves relate to gold as the medium for expressing their own shape in money.’


সাধারণত অনেকেই অনুমান করে থাকেন লেবার থিওরী অব ভ্যালু অনুযায়ী স্বর্ণের মধ্যেও হয়তো শ্রম আছে, তাই তার মূল্য আছে।

 

না, এটা সঠিক নয়। টাকা হিসেবে স্বর্ণ কে যখন মার্কস বিবেচনা করেছেন, তার একটা মূল্য তিনি ধরেছেন বটে। কিন্তু এই মূল্যটা “given” বা “প্রদত্ত”। অর্থাৎ, এটা শ্রমের ভিত্তিতে নির্ণীত নয়। এটা ধরে নেয়া। কিসের ভিত্তিতে ধরে নেয়া? উত্তর হতে পারে, “সামাজিক” ভিত্তিতে টাকা হিসেবে স্বর্ণের এই মূল্যটা ধরে নেয়া। দেখুন, মার্কস কি বলছেনঃ

‘We have already seen that the sphere of circulation has a gap in it, through which gold (or silver, or the money material in general) enters as a commodity with a given value. Hence, when money begins to function as a measure of value, when it is used to determine prices, its value is presupposed.’


সূত্রঃ

Capital: Volume 1; Chapter 3: Money, or the Circulation of Commodities

 

........

 

এই লেখাটি চিন্তা পাঠচক্রে কার্ল মার্কসের 'ক্যাপিটাল' গ্রন্থ পাঠের অংশ হিসেবে লেখা। তবে লেখাটি টাকা হিসেবে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা এবং কাগুজে নোটের পার্থক্য সংক্রান্ত বিষয়ে চিন্তা পাঠচক্র ফেসবুক গ্রুপের সদস্য আহমেদ শাহরিয়ার -এর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছি। তিনি ইনবক্সে প্রশ্ন করেছিলেনঃ

“কাগজী মুদ্রা নিয়ে মার্কসের অবজারভেশনটা একটু জানতে চাচ্ছিলাম। মুদ্রা হিসেবে কাগজের মুদ্রার (নোট টাকার) সাথে সোনা ও রুপা কে এক করে দেখা সঠিক হবে? সোনা ও রুপার মধ্যে শ্রম আছে, কিন্তু কাগজের টাকার মধ্যে কি কোনভাবে শ্রম আছে?”

চিন্তা পাঠচক্রে কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল সংক্রান্ত আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় উত্তরটি তাকে ব্যক্তিগতভাবে না দিয়ে চিন্তা পাঠচক্রের ফেসবুক গ্রুপে লেখাটি প্রথমে পোস্ট করা হয়েছিল। এখন লেখাটি চিন্তা ওয়েবসাইটে দেয়া হল। - হাসানুল হাসিব আল গালিব


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।